হজ্জ পালনকালীন সময়ে রসূল স. এর ভাষণ

৯ জিলহজ্জ আরাফাতে এবং সম্পূর্ণ হজ্জ সফরে রসূলুল্লাহ স. বেশ কয়েকটি ভাষণ
দেন। রসূলুল্লাহ স. এর বিদায় হজ্জের ভাষণ তাঁর প্রদত্ত ভাষণসমূহের মধ্যে সেই মর্যাদা রাখে, যে মর্যাদা রাখে মোতির মালায় মধ্যবর্তী মোতিটি (যা লকেট হিসাবে ব্যবহৃত হয়)। মুহাদ্দিসগণ এ ভাষণটি বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। শুধুমাত্র হযরত শাহ্ওয়ালী উল্লাহ্ দেহলভী (রহ) তার ‘ইযাতুল খিফা’ গ্রন্থে আশিটি পদ্ধতিতে ও আশিটি সনদে এই ভাষণটি বর্ণনা করেছেন। রসূলুল্লাহ স. ২৬ যিলক্বাদা মদিনা থেকে রওয়ানা হয়ে ৫ যিলহাজ্জাহ্ মক্কায় পৌঁছেন এবং ৯ যিলহাজ্জাহ্ দুপুরের পর আপন কাসওয়া উটনীর উপর বসে বসেই এই ভাষণ দেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। স্থান ছিল আরাফা প্রান্তর।

সমস্ত প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার প্রাপ্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য চাই, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাওবা করি। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি আমাদের নাফসের (রিপুর) অনিষ্টকারিতা থেকে এবং আমাদের আমরে অনিষ্ট থেকে। যাকে আল্লাহ তায়ালা পথ প্রদর্শন করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর যাকে আল্লাহ তায়ালা পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হিদায়াত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ স. তাঁর বান্দা ও রসূল।

হে আল্লাহর বান্দারা, আমি তোমাদেরকে অসীয়ত করছি এবং উদ্বুদ্ধ করছি এ ব্যাপারে
যে, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর। তোমাদের সামনে আমিই পুণ্য কর্মের সূচনা
করছি।

অতঃপর হে মানুষ, তোমরা আমার কথা শোনো। আমি তোমাদেরকে পরিষ্কার ভাষায় বলছি, এ বছরের পর এ জায়গায় তোমাদের সাথে আমার আর সাক্ষাৎ নাও হতে পারে। হে মানুষ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম করা হল, যেমন আজকের এ দিন, আজকের এ মাস তোমাদের এ শহর সকলের জন্য হারাম (পবিত্র ও নিরাপদ)। সাবধান, আমি তোমাদের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছে দিলাম। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক। তোমাদের মধ্যে যার কাছে অন্যের আমানত আছে, সে যেন তা তার তার (মালিকের) মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়।

জাহিলিয়া যুগের যাবতীয় সুদী কারবার আজ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদের দাবি মাফ করে দিলাম। জাহিলিয়া যুগের যাবতীয় রক্তের দাবিও আজ থেকে রহিত করা হল। সর্বপ্রথম আমি
‘আমির ইবনে রাবী‘আ ইবনে হারিছ ইবলে আবদুল মুত্তালিবের রক্তের দাবি রহিত
ঘোষণা করছি।
জাহিলিয়া যুুগের গর্ব করার এবং গর্বের কারণ হয় এমন সব পদের আজ থেকে পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হল। তবে কাবা ঘরের হিফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করানোর (এ দুটি) পদ বহাল থাকবে। জ্ঞাতসার হত্যার কিসাস (বদলা) নেওয়া হবে। যে হত্যা জ্ঞাতসারে হত্যার সাথে সামঞ্জস্যশীল অর্থাৎ লাঠি বা পাথরের আঘাতে যে হত্যা করা হয়, তার বদলা (বিনিময়) একশ উট নির্ধারণ করা হল। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশি চাবে, তার একাজ জাহিলিয়া যুগের কাজ বলে গণ্য হবে।

হে মানুষ, শয়তান এ ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে যে, এ যমীনে তার উপাসনা করা হবে না। কিন্তু সে এ ভেবে খুশি যে, উপাসনা করা না হলেও অন্যান্য গুনাহের কাজে তার আনুগত্য করা হবে।

হে মানুষ, বছরের মাসগুলোকে আপন জায়গা থেকে হটিয়ে দেওয়া কুফর বৃদ্ধি করারই নামান্তর। এর দ্বারা কাফিররা পথভ্রষ্ট হয়। এক বছর তারা এটাকে (হারাম মাসকে) হালাল এবং অন্য বছর হারাম বলে নির্ধারণ করে, যাতে আল্লাহ যা নির্ধারণ করে
রেখেছেন, সেটার গণনা পূর্ণ করার প্রয়াস পায়। নিশ্চয় যামানা (যুদ) ঘুরে ফিরে সে জায়গায় এসে গেছে, যেখান থেকে সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল। আল্লাহর কাছে রক্ষিত গণনায় মাসের সংখ্যা হচ্ছে বারোটি। এটা আল্লাহর কিতাবে (লাওহে মাহফূযে) সংরক্ষিত আছে। যখন থেকে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন
থেকেই চারটি মাসকে ‘হারাম’ (পবিত্র ও নিরাপদ) করা হয়েছে। তিনটি মাস ক্রমানুসারে পরস্পরের সাথে যুক্ত এবং সেগুলো হলো যিলকাদা, যিলহাজ্জাহ ও মুহাররম। বাকি একটি বিচ্ছিন্ন। আর তা হচ্ছে জমাদিউস সানী ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস রজব। সাবধান, আমি তোমাদের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ“ তুমি সাক্ষী থাক।

হে মানুষ তোমাদের উপর স্ত্রীলোকদের অধিকার রয়েছে এবং তাদের উপর তোমাদেরও
এ অধিকার রয়েছে যে, তারা অন্য কাউকে তোমাদের বিছানায় শুতে দেবে না এবং
তোমাদের অনুমতি ছাড়া এমন কোন লোককে ঘরে প্রবেশ করতে দেবে না যাদেরকে
তোমরা অপছন্দ কর। তারা যেন নির্লজ্জের মত কথা না বলে। যদি এরূপ করে তাহলে তুমি তাদেরকে পৃথক করে দিতে পার, পৃথক শয্যায় শোয়াতে পার, (অতি প্রয়োজনবোধে) মৃদু প্রহারও করতে পার। যদি তারা সে সব কাজ থেকে বিরত থাকে এবং তোমাদের আনুগত্য স্বীকার করে তাহলে তাদের খোরাক পোশাক ন্যায্যভাবে এবং নির্ধারিত পন্থায় সরবরাহ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব!
তোমাদের কাছে স্ত্রীলোকরা অবলা। তারা নিজ থেকে কিছু করতে পারে না। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত স্বরূপ পেয়েছ এবং আল্লাহর নামে নিজেদের জন্য তাদেরকে বৈধ করে নিয়েছ। অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে চল এবং তাদের জন্য মঙ্গল চিন্তা কর।

সাবধান! আমি তোমাদের কাছে সত্যের আহ্বন পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমিও
সাক্ষী থাকো।

হে মানুষ, সকল মুসলমান ভাই ভাই। কোন মুসলমানের পক্ষে আপন ভাইয়ের মাল তার মনস্তুষ্টি (সানন্দ অনুমতি) ছাড়া গ্রহণ করা বৈধ নয়। সাবধান! আমি সত্যের আহ্বান তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।

হে মানুষ, আমার পরে তোমরা (এমন) কাফির হয়ে যাবে না যে, একে অন্যের গর্দান
মারতে থাকবে।

আমি তোমাদের কাছে এমন একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা এর উপর আমল কর এবং এটাকে শক্তভাবে ধরে রাখ তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর সেটা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন)। সাবধান আমি সত্যের আহ্বান পৌঁছিয়ে দিয়েছি।

হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।

হে মানুষ, তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতাও এক। তোমরা আদম থেকে (সৃষ্ট) আর আদম মাটি থেকে। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকী। অনারবের উপর আরবের মর্যাদা নেই। শুধুমাত্র তাকওয়ার মাধ্যমে এ মর্যাদা নির্ধারিত হবে। সাবধান, আমি সত্যের আহ্বান তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমিও সাক্ষী থাকো।

হে মানুষ, শীঘ্রই তোমরা আল্লাহ কর্তৃক আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, তখন তোমরা কি জবাব দেবে? উপস্থিত সকলে বলে উঠে, আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি আমাদের কাছে আপনার রিসালতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন, উম্মতকে যথাযথভাবে উপদেশ দিয়েছেন, তাদের সামনে থেকে (অসত্যের) যবনিকা উঠিয়ে দিয়েছেন এবং আপনার উপর অর্পিত আমানত সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ স. তিন বার বলেন, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকো, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকো।, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকো।

অতঃপর বলেন, তোমরা যারা উপস্থিত আছ, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে এ বাণী
পৌঁছে দিও।

হে মানুষ, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য তার প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নিজের সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশের অধিক অসীয়ত করার অধিকার তোমাদের কারো নেই। ছেলে তারই যার বিবাহ বন্ধনে ছেলের মা রয়েছে। আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর ছাড়া কিছু নেই।

যে ব্যক্তি আপন পিতা ব্যতীত অন্য কাউকে পিতা বলে দাবি করে, কিংবা যে ক্রীতদাস আপন মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে দাবি করে, তার (তাদের) উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সমগ্র মানুষের অভিশাপ।

কিয়ামতের দিন এর কাছ থেকে কোন বদলা (বিনিময়) কবুল করা হবে না।

তোমাদের সকলের উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। (জামহারাতুল খুতাব)