বিশাল পৃথিবী। তার উপরে মহাকাশ। কোটি কোটি মানুষ বাস করছে এ পৃথিবীতে। নানান কারণে মানুষের মনের পরিচয় মেলে মানুষের কাছে। বড় মনের মানুষ মেলানো খুবই কঠিন। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে অন্যের যত ক্ষতিই হোক, তাতে কোন পরোয়া করছে না বনী আদম। তারপরও গুটি কয়েক বড় মনের মানুষ যে আজ পৃথিবীতে নেই, এমনটি কিন্তু নয়। এই তো আমার সাথে ডক্টরেট করোয়া আলহাজ্জ আদম ইউসুফ আব্দুল্লাহ। তাঁর মত বড় মনের মানুষ দু’ চারজন খুঁজে পাওয়া কঠিন। মানুষ হিসেবে তিনি আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন খুব কাল। গোটা শরীর কুচকুচে কাল, দাঁতের সারিগুলো ঝলমলে রুপালী। যদি মাঝে মধ্যে কখনো মুখ খুলে হাসেন, তাহলে যেন মেঘলা আকাশে বিদ্যুতের চমক।
১৯৮২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ স্কলারশিপে স্বস্ত্রীক লন্ডনের উদ্দেশ্যে বৃটিশ এয়ার ওয়েজে ঢাকা ত্যাগ করি। ৩০ তারিখের দুপুর নাগাদ নিউক্যাসল শহরে ১৬৮ মারিয়া স্ট্রিটে আমার ভায়রার বাসায় গিয়ে উঠি। দুদিন পরেই শুক্রবার। আমি চিন্তা করছিলাম জুম্মার নামায কোথায় পড়ি? ইতোমধ্যে আমার ভায়রা বললেন, বাকী তাড়াতাড়ি বের হও, ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জুম্মার নামায পড়ব। জায়গা ছোট, আগে না গেলে স্থান সংকুলান হবে না। আমি চমকে গেলাম। ইউনিভার্সিটিতে মসজিদ! তাও আবার জুম্মার নামায! যাহোক ভায়রার সাথে প্রথমে ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সেখানে ব্যাগ রেখে অল্পক্ষণের মধ্যেই দু’জন বের হলাম মসজিদের উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি মসজিদ ভরা মুসল্লি। ছোট চার তলা বিল্ডিং, চতুর্থ তলায় একটি অংশÑযাকে চিমনি কক্ষ বলে, সেখানে নামাযের ব্যবস্থা। খুৎবার বিষয়বস্তু এখন আমার মনে নেই। কিন্তু আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। জুম্মার খুৎবা এমন হতে পারে! কি সুন্দর আকর্ষণীয় উপস্থাপনা, দরদে ভরা বাচনভঙ্গি। আমি তখন আরবীতো মোটেও বুঝিনা, ইংরেজীও ততোটা না, কিন্তু আমিও মুগ্ধ হলাম। আমার যে ভায়রা বাংলাদেশে ঠিকমতো নামায পড়তেন না, তিনি বিলাতে এসে নামায পড়ার কারণ বুঝতে বিলম্ব হলো না আমার।
আমি ভায়রা ভাইকে বললাম, এ ইমাম কে? তিনি বললেন, তার নাম আলহাজ্জ, সে সুদানী। কৃষি প্রকৌশল বিভাগে পিএইচ ডি গবেষক। আমি বললাম, তার সাথে আমি কথা বলতে চাই। নামায শেষে আমার ভায়রা আমাকে ইমামের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তখন দাঁড়িয়ে মুসল্লিদের সাথে কুশল বিনিময় করছিলেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন ঘবি পড়সবৎ, বিষপড়সব. আমার ভায়রা তখন পরিচয় করিয়ে দিলেন যে, সে তিন বছরের জন্য পিএইচ ডি করতে এসেছে। আপনার বড় সাগরেদ হতে পারে। আমি আলহাজ্জকে বললাম, আপনার মত এত সুন্দর করে খুৎবা ও কুরআনের জ্ঞান কীভাবে অর্জন করা যায়? এ ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? তিনি আমাকে বললেন, আগামী কাল যুহরের নামাযের পরে আমরা এ ব্যাপারে কথা বলব। তোমার কাছে কি কোন কুরআন আছে? আমি বললাম হ্যাঁ, দেশ থেকে এক কপি নিয়ে এসেছি। তিনি বললেন সাথে আনিও। এরপর আমি সেখানে আসর মাগরিব ও এশার নামায পড়লাম। এশার পর যখন বাস ধরার জন্য মসজিদ বিল্ডিংয়ের উল্টা দিকে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মসজিদ বিল্ডিং এর উপরের দিকে নজর গেল। একটা সবুজ গম্বুজ বেশ পরিচিত। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, কবে কোথায় দেখেছি। নিউক্যাসলে এটাই আমার প্রথম আসা। ইতোপূর্বে কেউ এমন কোন ভিউকার্ডও পাঠাননি। বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় পড়লাম। মন থেকে যাচ্ছেনা। ইতোমধ্যে বাস আসল, বাসায় পৌঁছালাম। পরের দিন যুহরটা আমার কাছে বেশ দূরে মনে হল। সেদিন ছিল শনিবার। শনি রবি সাপ্তাহিক বন্ধ। কিছু কেনাকাটা আর ভায়রার সাথে ডিপার্টমেন্টে ঘুরার উদ্দেশ্যে বের হলাম। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া তরজমায়ে কুরআন মজিদ সঙ্গে নিলাম। বিলাতে যাওয়ার আগে শ্রদ্ধেয় মশিউল আলম ভাই এটা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে উপযুক্ত পুরষ্কার দিন। যুহরের নামাযের দশ পনের মিনিট আগেই মসজিদে গেলাম। নামায শেষে ভায়রা ডিপার্টমেন্টে চলে গেলেন, আলহাজ্জের সাথে আলাপ শেষে আমাকে ডিপার্টমেন্টে যেতে বললেন। আলহাজ্জের সাথে আলাপ
শুরু হল। তাঁর প্রথম প্রশ্ন, তুমি কি অর্থসহ কুরআন পড়েছ? আমি বললাম পুরো কুরআন পড়িনি। তিনি আমার হাতের কুরআন নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন। যেহেতু এটা আরবী ও বাংলাতে লেখা, তিনি বললেন, তুমি কি এটা পড়ে মজা পাও? আমাকে বেশ কয়েকভাবে প্রশ্ন করে বুঝাতে চাইলেন, যে এ তরজমাটা আমি সহজে বুঝতে পারি কি না? তার ইংরেজীটা ছিল উড় ুড়ঁ বহলড়ু ঃযব ঃৎধহংষধঃরড়হ? আমি বললাম হ্যাঁ, এটা পড়ে আমি আনন্দ পাই, আমার কাছে ভাল লাগে। তিনি বললেন, এ কুরআন শুধু অনুবাদ ছয় বার খতম করবে, তরজমা ছাড়া টিকা ব্যাখ্যার দিকে মোটেও নজর দিবে না। অন্য কোন হাদিস বই বা ইসলামি সাহিত্য পড়বে না, যতটুকু সময় দিতে পারো, তোমার গবেষণার কাজের পরে পুরো সময়টা কুরআনের অনুবাদ পড়ায় লাগাবে। কোন অসুবিধা হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করিও। এটা শেষ করার পর আমি পরবর্তী কর্মসূচি দেব। আমি তাঁর কথায় দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হলাম এবং ঐ দিন থেকেই কুরআনের তরজমা পড়া শুরু করলাম। আমি গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক পারা করে তরজমা পড়তে থাকি। আমি যখন দ্বিতীয়বার কুরআনের তরজমা খতম করি তখনই এ পদ্ধতির গুরুত্ব ও কার্যকারিতা উপলব্ধি করি। যতই দিন যায় ততই আমার আগ্রহ বেড়ে চলে। ছয় মাসের মধ্যে আমার ছয় খতম শেষ হয়। রাতে এবং সকালে আমি সাধারণত কুরআন পড়তাম। যেহেতু আরবী তেলাওয়াতে আমার খুব বেশি সময় লাগত না, বেশিরভাগ সময় তরজমাতেই দিতে পারতাম। আমার কুরআন পড়ার অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী এবং ভায়রা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। আমার ভায়রা মন্তব্য করেন, তুমি কি এখানে কুরআনের হাফেজ হতে এসেছ? এভাবে চললে তোমার পক্ষে পিএইচ ডি শেষ করা সম্ভব হবে না। আমি অবশ্য মোটেও পিছপা হইনি।
এ ব্যাপারে আমার মহান প্রভু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দুটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় আমাকে সাহায্য করেছেন। প্রথমটি হল, একজন ভাল মানুষকে আমার পিএইচ ডি সুপারভাইজার নির্ধারণ করা। আর দ্বিতীয়টি হলো কুরআনের ব্যাপারে আমার মধ্যে অবিস্মরণীয় আগ্রহ সৃষ্টি এবং সময় ব্যাবস্থাপনা। নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারাল বায়োলজি বিভাগে ডঃ আর এফ উইলকিনস ইতিমধ্যে ইচঐ নিয়ে গবেষণা করছেন। আমি ইচঐ নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছি শুনে আমার ভায়রা ঘাবড়ে গেলেন। ডঃ উইলকিনস কড়া মানুষ। একটু ধর্মবিদ্বেষীও। তিনি আমার সুপারভাইজার হলে আমি বেশ সমস্যায় পড়তে পারি, ভায়রা এমন আশঙ্কা করছেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, বিভাগীয় প্রধান যখন আলাপ করবেন, তখন তুমি ইচঐ ও ধানের বদলে গম বা মজুত শষ্যের উপর কাজ করার প্রস্তাব দিও। তাতে ডঃ কারসাও, ডঃ লাফ, ডঃ পোর্ট, ডঃ সেলম্যান ইত্যাদির মত লিবারেল ও হেল্পফুল সুপারভাইজার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২/৩ দিন পর বিভাগীয় প্রধান প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর রাসেল সাক্ষাত করতে বললেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে গবেষণার শিরোনাম সম্পর্কে আমার আগ্রহের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, ফরমে তো ইচঐ নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এটাতে কোন অসুবিধা থাকলে, আপনি যেটা বলবেন, আমি সেটাতেই সম্মত আছি। তিনি বললেন ইচঐ রিয়ারিং করতে হয় গ্রীন হাউজে। ধানের চাষ করার জন্য যেতে হবে পষড়ংব ঐড়ঁংব যা ঐবফড়হ ড়হ ঃযব ধিষষ এ অবস্থিত। এটা শহর থেকে বেশ দূরে। তোমার কষ্ট হবে। আমি বললাম, কষ্ট করতে আমার আপত্তি নেই। এটা নিয়ে আমি এম এসসিতে কাজ করেছি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটেও আমি ইচঐ সম্মন্ধে অনেক কিছু শিখেছি। আপনার অসুবিধা না হলে এটাই দিন। তিনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, চল দেখি ডঃ কারসাও রাজী হন কিনা। বিচিত্র ব্যাপার। তাঁর উচিত ছিল ডঃ উইলকিনসের কাছে যাওয়া। ইচঐ ছাত্রকে কারসাও এর কাছে তিনি কী হিসেবে নিলেন, তা আমার বোধগম্য হয়নি। ডিপার্টমেন্টের কেউই এটা বুঝেনি যে প্রফেসর রাসেল কেন আমাকে উইলকিনস বাদ দিয়ে কারসাও এর কাছে নিলেন? ডঃ কারসাও এর কাছে ইচঐ এর ছাত্র আমিই প্রথম এবং তিনি এ বিষয়ে কাজ করেননি। প্রফেসর রাসেল যদি নিজে আমাকে তাঁর সাথে নিয়ে না যেতেন, ডঃ কারসাও কিছুতেই এতে রাজী হতেন না। তিনি অবশ্যই আমাকে ডঃ উইলকিনসের কাছে পাঠাতেন। প্রফেসর রাসেল ডঃ কারসাও এর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমি চাই সে আপনার সাথে কাজ করুক। ইচঐ এর ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে। আপনি তাকে সাহায্য করবেন। আমাকে বললেন, এড়ড়ফ ষঁপশ. ঐব রং ুড়ঁৎ ংঁঢ়বৎারংড়ৎ. আশা করি কোন অসুবিধা হবে না। কোন সমস্যা হলে দেখা করিও। চলি।
উৎ. ঔযড়হ কবৎংযধি অত্যন্ত সহজ সরল ও মানব দরদী ছিলেন। তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের মত ছাত্রদের পিছনে লেগে থাকতেন না। সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট সময়ে এপয়েন্টমেন্ট দিতেন। পরবর্তী সপ্তাহের সকল কাজ বুঝিয়ে দিতেন। এর মধ্যে ছাত্রদের প্রয়োজন হলে তারা সহজেই তাঁর সাথে কথা বলতে পারত। সুপারভাইজার খুব ভাল মানুষ হওয়াতে তাঁদের দেশে ধান চাষ না হওয়া এবং বাদামি গাছ ফড়িং না থাকা সত্তেও তিনি এ বিষয়ে কাজ করতে সম্মত হন। আমার সুপারভাইজার যদি বেশি কঠিন ও জটিল হত, তাহলে হয়তবা আমি কুরআনের ব্যাপারে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে পারতাম না। গবেষণার জন্যে নতুন করে গ্রীন হাউজ ও অন্যান্য গবেষণা সরঞ্জামাদি বানানোর জন্য ডিপার্টমেন্টের টেকনিশিয়ানকে বুঝিয়ে দিলাম এবং ধানের বীজ পাঠানোর জন্য ফিলিপিনস্ত ওজজও তে চিঠি লিখলাম। আর নিয়মিত লাইব্রেরীতে লিটারেচার সার্চ করতে থাকলাম। এর ফাঁকে সপ্তাহে দু দিন ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজী ভাষা কোর্সের ক্লাশে যোগ দিতাম।
গ্রীন হাউজ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এবং ইরি থেকে ধান বীজ না এলে আমি গবেষণার কাজই শুরু করতে পারছি না। যদি কুরআন শিক্ষায় এতটা মজে না যেতাম তাহলে বরং আমার অসুবিধা হত। কাজ শুরু হতে দেরি হওয়ায় আমার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হত, বিরক্তি আসত। কিন্তু এ ফাঁকে কুরআন শিক্ষায় সময় দিতে পারার কারণে আমার মাঝে কোন হতাশা ও বিরক্তি আসেনি। সুপারভাইজারও এ ব্যাপারে কোন হা-হুতাশ করেননি। তিনি একদিন ইংরেজী কোর্স সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন চলছে ক্লাশ? কোন উপকার হচ্ছে কি? আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, খুব একটা বুঝতে পারছি না। তিনি বললেন, তুমিতো আর ইংরেজীতে পিএইচ ডি করতে আসনি, তোমার কথা আমি বুঝি, আমার কথা তুমি বুঝ, আরকি। তোমার ইংরেজী কোর্সে যাওয়ার দরকার নেই। ছয় মাসের মাথায় যখন আমার কুরআনের তরজমা পড়া শেষ হল, তখন আমার গ্রীন হাউজ তৈরির কাজও শেষ হল। গবেষণার সরঞ্জামাদিও হাতে এল এবং ফিলিপিন থেকে ধানের বীজও পৌঁছল। আমি পুরোদমে বাদামি গাছ ফড়িং এর পিছনে সময় দিতে থাকলাম। আল্লাহর কি বিশেষ মেহেরবানী, পিএইচ ডি গবেষণার কাজ শুরু করার আগেই ছয় মাসের মধ্যে কুরআনের তরজমা বার বার পড়ে শেষ করার ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন।
আলহাজ্জকে যখন জানালাম, কুরআন পড়া ছয় বার শেষ হয়েছে, তখন তিনি খুব খুশি হলেন। যদিও মাঝে মধ্যে তাঁকে আমার প্রগ্রেস জানাতাম। প্রতিবার খতমের সংবাদটাও জানাতাম। কিন্তু সত্যি সত্যি আমি ছয় মাসে ছয় খতম করেছি, তাঁর হাবভাব দেখে আমার মনে হয়েছে যে এটা তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য। তিনি আমাকে দু’চার জায়গা থেকে অর্থ বলতে বললেন, তাতে আমি সফল হলাম। তখন তিনি আমাকে মওলানা ফজলুর রহমান মুন্সির লেখা বার ভলিউমের ইংরেজী আল হাদিস বইটি পড়ার জন্য বললেন। এবং মসজিদ লাইব্রেরী থেকে প্রথম ভলিউমটি উঠিয়ে দিলেন। আমি পরবর্তী ছয় মাসে আল হাদীসের বারটি ভলিউম শেষ করি। আর মাসে একবার কুরআনের তরজমা খতম করা অব্যাহত রাখি। আলহাজ্জ আমাকে ছাত্রদের ইসলামিক সোসাইটির মসজিদে মাসিক স্টাডি সার্কেলে কিবর বা অহংকার সম্পর্কে কুরআন হাদীসের আলোকে পরবর্তী মাসের স্টাডি সার্কেলে একটি বক্তৃতা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে আমি প্রতিটি স্টাডি সার্কেলে উপস্থিত থাকতাম, কিন্তু তিনি কখনো আমাকে কোন বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দেননি। আমি সাধ্যমত কিবর এর উপর
নোট করার চেষ্টা করি, মাঝে মাঝে তাঁর সাথে আলাপ করার চেষ্টা করি এবং নির্দিষ্ট দিনে এক ঘণ্টার একটি বক্তৃতা প্রদান করি। শুরু হয় আমার ইসলামিক সোসাইটিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণের পালা। এখন মাঝে মধ্যে আলহাজ্জ তাঁর উপস্থিতিতেই আমাকে নামাযে ইমামতি করার আহ্বান জানান। প্রথমে আমার খুব ভয় হত, সংকোচ লাগত। পরবর্তীতে আলহাজ্জের বিদায়ের পর আমি ঐ মসজিদে জুম্মার খুৎবা ও ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছি নির্বিঘে।
আলহাজ্জ একদিন আমাকে বললেন, বাকী হজ্জে যাব, তোমার সময় আছে কি? আমি বললাম, হাঁ। আলহাজ্জ আমাকে কিছু বললে আমি নিজের সব কাজ ফেলে সেটা করতে
চেষ্টা করি। তিনি আরো ৬ জনকে প্রস্তুত করেছে হজ্জের জন্যে। মোট ৮ জন যাব। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, হজ্জের জন্যে মোট কত পাউন্ড লাগবে? তিনি বললেন
৪০০ পাউন্ড। অন্যদেরও তিনি ৪০০ পাউন্ড নিতে বললেন। কিন্তু তিনি আমাকে সাথে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর একাউন্টে কত টাকা আছে? ব্যাংক বলল
১২০০ পাউন্ড। তিনি ১২০০ পাউন্ডের একটি চেক দিয়ে সব টাকা উঠিয়ে ফেললেন। আমি তো অবাক, কি ব্যাপার? হজ্জের সময় সে এত টাকা দিয়ে কি করবে, অথচ আমাকে ৪০০ পাউন্ড নিতে বললেন? আমি জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, আপনি এত টাকা উঠাচ্ছেন কেন? উত্তরে বললেন, তুমি শুধু প্রশ্ন কর। শোন, এমন এক ব্যাংকে টাকাগুলো রাখব, যেখানে আরো অনেক বেশি লাভ হবে। শুধু এই ১২০০ পাউন্ড নয়, আরো ৩ হাজার পাউন্ড খারতুম ব্যাংক থেকে পাঠিয়ে দিতে বলেছি। আমি তাঁর কথার তাৎপর্য বুঝলাম না, ভাবলাম সৌদিতে হয়ত কোন একাউন্ট খুলবেন।
আমি সাথীদের বললাম, আপনারা সবাই ৪০০ পাউন্ড নিচ্ছেন অথচ আলহাজ্জ ১২০০ পাউন্ড, এমনকি আরো ৩ হাজার পাউন্ড আসছে। এ কথা শুনে তাঁকে অন্যরা জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাই আপনি নাকি ১২০০ পাউন্ড নিচ্ছেন। আমাদেরকে ৪০০ পাউন্ড নিতে বললেন কেন? প্রয়োজন হলে আমাদেরকে বলেন, আমরা আরও নেই। তিনি বললেন না না, আর লাগবে না। প্রয়োজনীয় মাল সামানের মধ্যে প্রত্যেককে এক লিটার সাইজের একটি ফ্লাস্ক/কনটেইনার/বোতল কিনতে বললেন। আমরা নিউক্যাসলেই তা কিনে ফেললাম। তিনি বললেন, সৌদিতে কিনবেন।
নির্দিষ্ট দিনে হজ্জের সফর শুরু হলো। নিউক্যাসল থেকে হিথরো রেন্ট এ কার এ আলহাজ্জ ড্রাইভ করে নিয়ে আসলেন। বৃটিশ বিমানে হিথরো থেকে জেদ্দা। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে এসে মক্কা যাওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা। সঙ্গীদের মধ্যে একজন-দুজন করে দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে আসেন। কিন্তু আলহাজ্জ গিয়ে আটজনের জন্য রুটি নিয়ে আসলেন। আমরা তো অবাক। কী ব্যাপার এত রুটি কেন? তিনি বললেন, এইতো সবাই মিলে খাব। সকলের হাতে তিনি একরকম জোর করে রুটি দিলেন ও খাইয়ে ছাড়লেন। ৭ জিলহজ্জ মিনা রওয়ানার পূর্বক্ষণে তিনি ১০/১২ লিটারের এক বড় ফ্লাস্ক কিনে আনলেন। অবাক বিস্ময়ে বললাম, আমাদেরকে নিতে বললেন ১ লিটার বোতল, আর নিজে কিনলেন ১০/১২ লিটার ফ্লাস্ক। তিনি বললেন, মিনা আরাফাতে প্রচ- তাপ, তাই এটি নিলাম।
মাগরিবের সময় জেদ্দা থেকে মক্কায় পৌঁছলাম। বাস থেকে যেখানে নামলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে মাগরিবের জামাতে শরিক হলাম। নামায শেষে আলহাজ্জ আমাদেরকে মুয়াল্লিম অফিসে নিয়ে গেলেন। আমরা দেখলাম, তিনি অনেকক্ষণ মুয়াল্লিমের সাথে কি যেন বলাবলি করছেন। ঘণ্টা খানেক পর বললেন, আমরা এই মুয়াল্লিমের সঙ্গে থাকব না। সে যে রুম আমাদেরকে দিতে চায়, সেটি আমাদের জন্য উপযুক্ত না। তোমরা যদি চাও তাহলে আমি নিজে গিয়ে পছন্দ মত বাসা ভাড়া করব। তাতে পয়সাও কম লাগবে, আরামেও থাকা যাবে। আমরা সবাই বললাম, আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করেন। ইতোমধ্যে এক ভদ্র মহিলা মুয়াল্লিমের সাথে কথা কাটাকাটি করে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে
বের হয়ে যাচ্ছিল। আলহাজ্জ তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার, কী হয়েছে? মহিলা তাঁকে জানালেন, তাকে যে রুম দেওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক খারাপ মানের রুম দিতে চাচ্ছে। আমার ঠিক মনে আসছে না, সম্ভবত ঐ রুমে আর কোন মহিলাও ছিল না। ভদ্র মহিলা তাকে মহিলাদের সাথে রুম দেওয়ার অনুরোধ করেন, একান্ত সম্ভব না হলে টাকা ফেরত দিতে বলেন। তিনি অন্য মুয়াল্লিমের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু মুয়াল্লিম তার কথা মানছে না। মহিলার কাছ থেকে তার বক্তব্য শুনার পরে আলহাজ্জ আমাদেরকে একটু বসতে বলে মহিলাকে নিয়ে মুয়াল্লিমের কাছে গেলেন। মুয়াল্লিমের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে বেশ কয়েকবার কয়েকটি রুমে উঠা নামা করে শেষ পর্যন্ত মহিলার জন্য একটা ব্যবস্থা করে ফিরে আসলেন। এরপর আলহাজ্জ আমাদেরকে নিয়ে মুয়াল্লিম অফিস থেকে বাইরে আসলেন এবং আমরা সেখানে অপেক্ষা করতে থাকলাম। প্রথম বার হজ্জে এসেছি সবাই কোন দিক যাই কোথায় বাসা ঠিক করি, কিছুই বুঝি না। কেবল আলহাজ্জই আরবীতে কথা বলতে পারেন। সুদানের লোক, খারতুম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। দু’ একজনের সঙ্গে আলাপ করলেন। এদিকে এশার আযান হল। ব্যাগ বোস্কা সব আমাদের সাথেই আছে। সিদ্ধান্ত হল, এভাবে এখানে এশার নামায পড়া হবে, বাসা ঠিক হওয়ার পর লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে উমরা পালনের জন্য হারামে যাওয়া হবে। ইতোমধ্যে একজন বাঙ্গালি বাসা পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে চাইলেন। তার কথা শুনে মনে হলো বাসাটি আমাদের পছন্দ হবে। লাগেজসহ সবাই আমরা কথিত বাসায় গেলাম, কিন্তুু বাস্তবে তা আমাদের মোটেও পছন্দ হল না। হারামের বাইরে প্রধান জামাতের সাথেই এশার নামায পড়লাম। আমাদেরকে ব্যাগ-ব্যাগেজসহ এক জায়গায় রেখে আলহাজ্জ বের হলেন বাসা ঠিক করতে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদেরকে নিয়ে একটি দু’তলা বাসার একটি রুমে উঠলেন। আমরা এত ক্লান্ত ছিলাম যে এখন আর বাসার অবস্থা দেখার মানসিকতা ছিল না। সবাই শুয়ে গেলাম। ঘণ্টা দু’তিনেক পরে আলহাজ্জ আমাদেরকে উঠালেন, এবং উমরার জন্য হারামে নিয়ে গেলেন। আমাদের কাফেলার আটজনের মধ্যে সাতজনই ছিলাম বাঙ্গালী। তিন জন বয়ঃবৃদ্ধ সিলেটি ও একজন মহিলা সিলেটি। আমাদের মত আলহাজ্জেরও প্রথম হজ্জ ও প্রথম হারামে আসা। তিনি অত্যন্ত স্থির ও শান্তভাবে আমাদেরকে নিয়ে হারামে প্রবেশ করলেন। জোরে জোরে দু‘আ পড়ছেন এবং আমাদেরকে তাঁর সাথে দু‘আ পড়তে বলছেন। গোটা হারামে এক চক্কর দিলেন, মনে হল সবকিছু বুঝে নিলেন। কোথায় থেকে শুরু কোনদিকে যেতে হবে, অত্যন্ত সুন্দরভাবে নির্ধারণ করে ফেললেন। কোন অধৈর্য নেই, অস্থিরতা নেই। কাউকে জিজ্ঞাসা করা নাই, অন্য কোন কথাবার্তাও নেই। একেবারেই শান্তিপূর্ণভাবে হাজরে আসওায়াদ নির্দেশক লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনে হল, তাঁর কতদিনের পরিচিত জায়গা। আমাদেরকে বললেন, এখান থেকেই তওয়াফ শুরু। তওয়াফের নিয়ত কর এবং ঘুরে এ দাগে আসলে এক চক্কর হবে। এমনিভাবে সাত চক্কর দিতে হবে, তোমরা ইচ্ছা করলে একাকীও তওয়াফ সম্পন্ন করতে পার বা আমাকেও অনুসরণ করতে পার। আমরা তাঁর সাথে থাকার মত দিলাম। তওয়াফ শুরু হল।
জীবনের প্রথম তওয়াফ। মনে হল সব আবেগ আগ্রহ উদ্দীপনা চোখ বুক মুখ ফেটে বের হতে চাচ্ছে। আলহাজ্জ আমাদের সামনে জোরে জোরে দু‘আ পড়ছেন। ছোট ছোট
দু‘আ, স্পষ্ট উচ্চারণ, যেন আমাদেরকে তওয়াফ করাচ্ছেন। আমাদের জন্য আমাদের মত করে যা যতটুকু দরকার তাই করাচ্ছেন। আবার তাঁর নিজের তওয়াফও উপভোগ করছেন। মাঝে-মধ্যে যখন আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাতাম, আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতাম, কীভাবে তাঁর প্রভুর প্রতি নিজেকে স্থির রেখে একই সময়ে আমাদেরকে গাইড করছেন। আমার জীবনে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তওয়াফ শেষ হল। মাকামে ইব্রাহিমে দু’রাকাত নামায পড়ে মুলতাযিমে দু‘আ করালেন। এরপর যমযমের মূল কূপের কাছে (নিচতলায়) গিয়ে পেট ভর্তি করে পানি খাওয়ালেন। তারপর সাফা মারওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। উভয় পাহাড়েই মধ্যখানের একটু বেশি উপরে উঠে কাবা চোখে পড়ে এমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে দু‘আ করতেন প্রতি চক্করে। সাঈ শেষে চুল কেটে ইহরাম শেষ করলেন। আমি হজ্জে কিরান করায় ইহরাম ছাড়লাম না। তাঁর তত্ত্বাবধানে তওয়াফ সাঈ সহ উমরার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অতি সহজে পালন করা সম্ভব হল।
মনে হল কোন এক বড় অভিজ্ঞ বেশ কয়েকবার হজ্জ পালনকারী মুয়াল্লিমের তত্ত্বাবধানে উমরা পালন করলাম। তওয়াফের সময় আল্লাহ তায়ালার দিকে সকল চিন্তা-চেতনা ও আবেগ অনুভূতি “কনসেনট্রেট” করার বাস্তব প্রশিক্ষণ প্রদান করলেন। হাজরে আসওয়াদ এবং মুলতাযেম ছাড়া কাবার অন্য কোন অংশ স্পর্শ করা চুমু খাওয়া নিষেধ। এ বিষয়গুলো আমাদেরকে এমনভাবে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, অগণিত মানুষ প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে যে ভুল করে, আমরা তা থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হই। হাজরে আসওয়াদে পৌছার ব্যাপারে, হাতেমে নামায পড়ার ব্যাপারে সব সময় আমাদেরকে পিক টাইমগুলো এড়িয়ে চলতে বলতেন। যে সময় ভিড় কম থাকত এবং লোকজন সহজে সেখানে যেতে চাইতনা, যেমন দ্বিপ্রহরের সময়, মধ্যরাতে এ সময়গুলোতে সেখানে যেতে বলতেন।
একদিন যুহরের নামাযের সময় আমাকে নিয়ে মাতাফে নামায পড়ার জন্য গেলেন। তখন তীব্র রোদে মাতাফের চাতল প্রচ- গরম ছিল। আমার পক্ষে খালি পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিলনা। আমাকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে নামায পড়তে বললেন। নামায শেষে তওয়াফ শুরু করলেন। আমি সেন্ডেল পায়ে তওয়াফ করছিলাম। অন্যান্য তওয়াফকারীদের অনেকের দৃষ্টি আমার দিকে। কেউ কেউ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে, কেউ ইহরামের কাপড় টেনে ধরে। কেউ হাত ধরে ঝাঁকানী দেয়। কেউ বড় বড় চোখ করে তাকায়, আবার কেউ দু’হাত দিয়ে এমন ভাবে ভঙ্গি করে যে আমি এটা কি করছি। কাবাতে সেন্ডেল পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এটা যেন এক মহা অন্যায় করছি। কিন্তু আলহাজ্জ আমাকে সেন্ডেল খুলতে দেননি। তাঁর কাছে এসব প্রতিবাদ ইশারা ইঙ্গিতের কোন দাম নেই। শেষ পর্যন্ত আমরা লক্ষ্যে পৌঁছি এবং রুমে ফিরে যাই। আমাদের সঙ্গীদের কেউ কেউ সেন্ডেল পড়ে নামায ও তওয়াফের বিষয়টি লক্ষ্য করেন। তাঁরাও আমার তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। এবং আলহাজ্জকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলেন। আলহাজ্জ বললেন, আমিইতো তাকে এটা করতে বলেছি। তোমরা কি মনে কর আমি বিষয়টি নাজেনে করতে বলেছি? কাবা ও হারামের সম্মান মর্যাদা সম্পর্কে আমার কোনই ধারণা নেই? সঙ্গীরা নাছোড়বান্দা। প্রমাণ দেখাতেই হবে। আলহাজ্জ মুচকি হেসে বললেন, কী দেখতে চাও? তোমরা কি আরবী পড়তে পার? বুঝতে পার? তাহলে তো কিতাবে দেখাতে পারি। সঙ্গীরা উত্তেজিত হয়ে বললেন, “দেখা তোর কিতাব দেখা। ব্যাটা কিতাবের কথা বলে। কিতাব পাবে কোথায় এখানে?” তাদের কণ্ঠ বেশ উত্তেজিত। আলহাজ্জ তাঁর ব্যাগ থেকে বিশাল আকৃতির একটি কিতাব বের করলেন, এবং এক ফাঁকে আমরা দেখলাম, সুটকেসে ঐ রকমের আরও কয়েকটি কিতাব। আমি বললাম, আপনি এসব কখন কিনলেন? তিনি বললেন তোমরা যখন গহনা কিনতে যাও, তখন বই কিনে নিয়ে আসি। তিনি নির্দিষ্ট কিতাবের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বের করলেন এবং বললেন যে, নাও পড়! কিন্তু আমরা কেউ হরকতবিহীন আরবী পড়তে পারি না। বাঙ্গালীদের মধ্যে আমি একটু একটু পড়তে পারি। কিন্তু সৌদি স্টাইলের ছাপা আর হরকত না থাকায় আমি পাঁচ ভাগও পড়তে পারি না। সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করলেন। অবশেষে আলহাজ্জকে বলা হল, আপনিই পড়ুন। আলহাজ্জ বললেন, আমি কিন্তু ঊহমষরংয ঞৎধহংষধঃরড়হ করতে পারব না। সঙ্গীদের মধ্যে বয়ঃবৃদ্ধ ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “পড় ব্যাটা পড় ঞৎধহংষধঃরড়হ করতে হবে না। আমরাও একটু আধটু আরবী বুঝি।” আলহাজ্জ দু’পৃষ্ঠা আরবী পড়লেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করা আছে টিকাতে। কিন্তু আমরা তো আরবী কিছুই বুঝিনা। এ বিষয়ে আমরা কোন দিন কিছুই শুনিনি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক আলহাজ্জকে শেষ পর্যন্ত ইংরেজীতে অনুবাদ করার জন্য অনুরোধ করলেন। আলহাজ্জ ইংরেজিতে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন। রেফারেন্স উল্লেখ করে বইয়ের পৃষ্ঠায় আঙ্গুল দিয়ে শিশুদেরকে যেমন করে বুঝায় তেমনিভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। বিন্তু না, সঙ্গীরা জেদ ধরলেন, তোমার কথা আমরা বিশ্বাস করি না। তুমি এ ব্যাপারে ভাল একজন আলেমের মতামত নাও। আলহাজ্জ বললেন দু’এক জন আলেমের নাম দাও। তাঁরা বললেন, মক্কায় আমরা কোন আলেমকে চিনি না। তকলিছ মিয়া বললেন, তুমি কাবার ইমামের কাছ থেকে শুনে নাও। আলহাজ্জ বললেন, ইমাম তো আরবীতে কথা বলবেন। ইংরেজীতে বলবো আমি, আমার উপর বিশ্বাস না থাকলে কেমন করে সমাধা হবে। “আমরা এত কিছু বুঝি না, তুমি ইমামের সাথে আলাপ করার ব্যবস্থা কর”, সমস্বরে বলে উঠল সবাই।
কথামত দু-তিন দিনের মধ্যেই কাবার প্রধান ইমাম শায়েখ সুহাইল এর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। আলহাজ্জসহ মোট চার জন যাবেন। আমি বাদ। কারণ আমি আলহাজ্জের
লোক। নির্দিষ্ট দিনে তিনজনসহ আলহাজ্জ রওয়ানা দিলেন। তকলিস মিয়া বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় একটু পিছনে ছিলেন, বাকি দুজনকে নিয়ে আলহাজ্জ ইমামের কক্ষে প্রবেশ করেন। দরজা আটকে দেন নিরাপত্তা প্রহরী। পিছনে পিছনে তকলিস মিয়া আসলে তিনি তাঁকে আটকে দেন, এবং বাইরের রুমে অপেক্ষা করতে বলেন। খানিকটা পরে আলহাজ্জ দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং তকলিস মিয়াকে লক্ষ্য করে ঐব রং সু নৎড়ঃযবৎ, ঐব রং রিঃয ঁং বলে তকলিস মিয়ার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যান। মাতাফে সেন্ডেল পরার বিষয়সহ আরও অন্যান্য বিষয়ে ইমামের সাথে প্রায় ঘণ্টা খানেক আলোচনা হয়। রুমে ফিরে কারো কোন কথা নেই। অথচ আমি অধীর আগ্রহে আলোচনার ফলাফল শুনতে অপেক্ষা করছি। বাকি যে তিনজন যাননি তাঁরাও ইমামের মতামত জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। আলহাজ্জ শুধু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দেয়। আমি বুঝতে পারি তাঁর ইশারা। শেষ পর্যন্ত বাকি তিনজনের চাপে মুখ খুললেন তকলিস মিয়া। তিনি বললেন, অষযধু রং মৎবধঃ সধহ. সে রুম থেকে বের হয়ে এসে আমাকে তার ভাই বলে ভিতরে নিয়ে গেছে। আর ইমাম আলহাজ্জ সম্পর্কে বললেন ঞযরং রং ঃযব ভরৎংঃ ঃরসব রহ সু ষরভব, ও ংবব ধ সধহ যিড় শহড়ংি ধহফ ঢ়ৎধপঃরপবং ধহফ ফড়বং হড়ঃ পধৎব যিধঃ ড়ঃযবৎ ঢ়বড়ঢ়ষব ধৎড়ঁহফ ংধু. ওভ ঃযবৎব বিৎব ঃবহ ংঁপয ঢ়বড়ঢ়ষব ফড়রহম ঐধলল বধপয ুবধৎ, ঃযব পড়হফরঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঁসসধয ড়িঁষফ যধাব রসঢ়ৎড়াবফ ধ ষড়ঃ নু হড়.ি আলহাজ্জ কিন্তু একবারও যারা মাতাফে সেন্ডেল পড়ার ব্যাপারে এতকিছু বলল, তাদেরকে কোন বকাবকি রাগ করা বা দেখলেন তো, কি বুঝলেন, কেমন মনে হয়, এ ধরনের কোন মন্তব্য করেননি। এ ঘটনার পর তাঁর প্রতি আমার আস্থা আরো বেড়ে গেল।
৭ই জিলহজ্জ রাত্রে মক্কার বাসাতে আমাদের পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা হেঁটে হজ্জ করব। সে অনুপাতে আমরা পরের দিন হেঁটে মিনায় রওয়ানা দিলাম। এটা ছিল
১৯৮৪ সাল। এখনকার মত মিনার ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা এতটা উন্নত ছিল না। মিনায় আমাদের তাঁবু খুঁজে পেতে বেশ হিমশিম খেতে হল। আমরা সাতজনের কেউই আরবী বুঝি না। বলতেও পারি না, সুতরাং আলহাজ্জকেই আমাদের তাঁবু কোথায় কোনদিকে কতদূর এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমি প্রচ- অসুস্থ হয়ে পড়ি। আলহাজ্জ আমাকে একস্থানে পাটিতে শুইয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়াকে সঙ্গে নিয়ে তাঁবুর খোঁজে বের হন এবং অন্যদেরকে আমার প্রতি লক্ষ্য রাখতে বলেন। ঘণ্টা দুয়েক পরে ভূঁইয়া আলহাজ্জসহ ফিরে আসেন, আমাদের তাঁবুর খোঁজ নিয়ে। আলহাজ্জ এসে আমার বিছানার কাছে শুয়ে পড়েন এবং তাঁর নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। প্রচ- রোদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ হাঁটাহাঁটি ও পরিশ্রমের কারণে তাঁর এ অবস্থা। ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পরে আমাদেরকে নিয়ে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে পৌঁছেন। আমি তখন বেশ অসুস্থ , আলহাজ্জের জন্য কিছুই করতে পারিনি। মাগরিবের পর তিনি বরং আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান এবং ঔষধ পথ্য নিয়ে আসেন। আমি যখন তাঁকে বললাম, আপনার কথাও বলুন। তিনি বললেন, আমার কোন সমস্যা নেই, আমি সুস্থ। ডাক্তারকে তিনি কিছুই বলতে দিলেন না। এশার নামাযের পরে তিনি আমাকে নিয়ে খাবারের জন্য বের হলেন, ফিরে এসে এক আজব কথা শুনালেন। বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে এখানে রাত যাপন করতে পারব না। কারণ আমরা সবাই ইংল্যান্ড থেকে আসলেও এশিয়া, ইউরোপ আফ্রিকা এর নাগরিকত্ব অনুযায়ী ক্যাম্প ভাগ করা হয়েছে। আমরা ৭ জন বাঙ্গালী হিসেবে এ ক্যাম্পে, আর আফ্রিকান হিসেবে তিনি অনেক দূরে আর এক ক্যাম্পে স্থান পেয়েছেন। আমরা তাঁকে ছাড়তে নারাজ।
এমতাবস্থায় তিনি বললেন আমি একটা শর্তে এখানে আসতে পারি। তা হল তোমরা সবাই আমাকে তোমাদের মেহমান হিসেবে এ ক্যাম্পে থাকার অনুমতি দিবে। নতুবা এখানে থাকা আমার জন্য সঠিক হবেনা। আমরা সবাই সমস্বরে তাঁকে আমাদের মেহমান হিসেবে আমাদের ক্যাম্পে থাকার জন্য ঘোষণা দিলাম। তিনি আমাদের সঙ্গে আমাদের ক্যাম্পেই থাকলেন।
এশার নামায ও খাবার শেষে আমাদেরকে জানালেন মুয়াল্লিমের লোকেরা ফজরের সময় হওয়ার আগে থেকেই আরাফাতে যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি শুরু করবে। তোমরা এসবে কান দিবেনা। আমরা ফজরের নামায শেষে সূর্যোদয়ের পর নাস্তা খেয়ে আরাফাত অভিমুখে রওয়ানা দিব। সত্যি-সত্যিই রাত তিনটার দিকে মুয়াল্লিমের লোকেরা ডাকা- ডাকি শুরু করল। আগে গিয়ে গাড়িতে সিট নেন। পরে জায়গা পাবেন না, হেঁটে যেতে হবে, রাস্তা ভুল করবেন ইত্যাদি অনেক কড়া কড়া কথা তারা শুনাতে লাগল। আশপাশ থেকে লোকজন যাওয়া শুরু করলো। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো আমাদের মধ্যেও দু’চারজন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু আলহাজ্জ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আমরা সূর্যোদয়ের পরে মিনা ত্যাগ করব। শেষ পর্যন্ত তাই করলাম।
আরাফার মাঠে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় সেখানকার একমাত্র মসজিদ, মসজিদে নামিরা যেখানে হজ্জের প্রধান খুৎবা অনুষ্ঠিত হয় তা লোকে লোকারণ্য। মসজিদের চত্বর থেকে আধা মাইল দূরেও মানুষ কাতারবন্দী হয়ে বসে পড়েছে। আমাদের সাথীদের পরামর্শ হলো তাঁবুতে চলে যাওয়া। অথবা এখানেই ফাঁক মতো বসে পড়া। কিন্তু আলহাজ্জ দৃঢ়, আমাদেরকে মসজিদেই নিয়ে যাবে। যতই সামনে আগাই ততই বাড়তি ভিড়। মনে হয়, কোনভাবে ভিতরে প্রবেশ সম্ভব নয়। একজন দু’জন হলে তাও এক কথা, আটজন লোকের জন্য এতবড় ফাঁকা জায়গা কে করে দিবে, কীভাবে করবে? সাথীদের একজন বাংলায় বলে উঠলেন, এই ব্যাটা আলহাজ্জ, “তোর বাপ কি এখানে জায়গা কিনে রেখেছে? রাখলেও মরার পরে ওখানে যাস।” অন্য আর একজন বলে উঠলেন, “ওই ব্যাটা, আমাদেরকে নিয়ে এখানে মরতে এসেছো?” আলহাজ্জ নির্বাক। তিনি এক কাতারের পিছনে দাঁড়ান, আর চার দিকের লোকজন আমাদের দিকে তাকায়। আমাদের খুব অস্বস্তি লাগে। আলহাজ্জ বলেন, ঐ দেখ ফাঁকা দেখা যায়। খবঃং সড়াব. সেখানে গিয়ে দেখা গেল খুব জোর দু’জনের জায়গা হবে। একটু পরে আবার আলহাজ্জ বলেন, খবঃং সড়াব নৎড়ঃযবৎ. ওখানে দেখ, আরো ফাঁকা জায়গা আছে। শেষ পর্যন্ত আমরা এভাবে মসজিদ চত্বরে ঢুকে পড়লাম। এবং প্রধান জামাতের সাথে যুহর আসরের নামায আদায় ও হজ্জের খুৎবা শুনলাম। খুৎবা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মানুষ ছুটে বের হয়ে আসে মসজিদ থেকে। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আলহাজ্জ বললেন, গড়াব য়ঁরপশষু. কিন্তু আমরা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে আমি খুবই দুর্বলতা অনুভব করছিলাম। পিছন থেকে
যে বেগে মানুষের ধাক্কা আসছিল, সে বেগে আমরা সামনে এগুতে পারছিলাম না।
আলহাজ্জ আমাদেরকে দু’টি সারিতে ভাগ করে, সবার শেষে নিজে থেকে এবং তাঁর লম্বা দু’পা, দু’হাত দিয়ে আমাদেরকে ধীরে ধীরে একপাশে নিতে সমর্থ হন। এরপর আমাদের জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেন। আমি যেহেতু অসুস্থ তাই আমার জন্য বেশকিছু কমলা নিয়ে আসেন। বলেন তুমি ভাত খাবেনা, যতটা পার কমলা খাও। এরপরে আমাদেরকে নির্ধারিত তাঁবুতে নিয়ে আসেন। তাঁবু খুঁজে বের করতে অনেক বেগ পেতে হয়। আমাকে এক জায়গায় বিছানা করে শুয়ে থাকতে বলেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে ইরানীদের একটি কাফেলা এসে ঐ জায়গাটি তাদের বলে দখল করে নেয়। আমরা পড়ি মহা বিপাকে। আলহাজ্জ বলেন, আর তাঁবুতে থাকার দরকার নেই, কারণ তাঁবুতে থাকলে আলসেমি লাগবে এবং জাবালে রহমতে পৌঁছা সম্ভব হবে না। বরং চল আমরা এখনি জাবালে রহমতে চলে যাই। একইসাথে জানিয়ে দিলেন “তোমাদের তো মনে আছে নিশ্চয়, যে আমরা জাবালে রহমতে সেই পাথরটির কাছে যাব, যার ওপর দাঁড়িয়ে রসূলুল্লাহ স. খুৎবা দিয়েছিলেন। তাঁবু থেকে জাবালে রহমত বেশ দূর। হেঁটে চলেছি সবাই। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পড়ে গিয়ে আমার হাতে ব্যাথা পেলাম। অন্যেরা আর পারছে না। পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে এসে সবাই বসে পড়লেন। এখান থেকে আর নড়বেন না। আলহাজ্জকে বললেন তুমি যেতে চাও যাও, কিন্তু আমরা যাব না। আলহাজ্জ আমাকে হাত ধরে টানলে আমি তাঁর সাথে চললাম। সাথীরা সবাই তাঁর উপর ক্ষেপে গেলেন। বেশ গাল মন্দ শুরু করলেন। তিনি বললেন, দেখ ঐ যে পাহাড় ছাতার মত, তার উপর প্রতি ইঞ্চি জুড়ে রয়েছে মানুষ। তারা যখন নেমে আসবে, তখন আমরা এখানে দাঁড়ালে মানুষের স্রোতে টিকা সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদেরকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। সাথীরা বলছেন না, আমরা যাব না, যা হয় হবে। এক পর্যায়ে আলহাজ্জ বললেন, তাহলে তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি একটু ঘুরে আসি, কোন সুবিধামত জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখে আসি। তোমরা কিন্তু এখান থেকে একটুও নড়বে না, ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি, প্রায় আধা ঘণ্টা। কালো চেহারার ক্লান্ত মানুষটি হাঁসিতে রুপালী দাঁতের সারি দুটি উজ্জল করে এসে বললেন, চল খুব চমৎকার একটা জায়গা পেয়েছি। দেখবে সেখানে পাহাড় কত সুন্দর ঢালু হয়ে আছে ছাতার মত। তিনি সামনে আগান, সাথে আমি। আমার পিছনে বাকিরা। আলহাজ্জ যখন আমাদেরকে নিয়ে ওই কাক্সিক্ষত স্থানে পৌঁছলেন তখন সবাই খুশি। সবাই ভুল স্বীকার করলেন। আলহাজ্জ বললেন, এইতো সেই পাথর, যেখানে রসূলুল্লাহ স. দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়েছিলেন। আমরা সেখানে মাগরিব পর্যন্ত অত্যন্ত নিশ্চিন্তে নির্বিঘেœ দাঁড়িয়ে বসে উকুফ করলাম। কোন ঝামেলা নেই, ঠেলাঠেলি নেই, চিৎকার হৈ চৈ নেই। অল্প সংখ্যক মানুষ আপন মনে প্রাণভরে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ আবেদন নিবেদন জানাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সামনে পাশে একটু দূরে দৃষ্টি গেলে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে খরস্রোতা নদীর মত নেমে যাচ্ছে। যেখানে কারো পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা আসলেই সম্ভব ছিল না। আমি আশ্চর্যাান্বিত হয়ে ভাবলাম, আলহাজ্জ কীভাবে এ কথাটি তখন আমাদেরকে বলেছিলেন? উকুফ শেষে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হলাম সূর্যাস্তের পর। দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছি আমরা। কিছুদূর যেতেই দলের মহিলা সাথী এবং বৃদ্ধ দু’জন আর হাঁটতে পারছেন না। তারা বললেন, গাড়ির ব্যবস্থা কর। হেঁটে মুযদালিফা যেতে পারব না। অথচ আরাফাতেও আলহাজ্জ আমাদের মতামত নিয়েছেন। আমরা হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। আলহাজ্জ বললেন, এখানে কোন গাড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ সবাই আরাফা থেকে গাড়ি নিয়ে মুযদালিফা যাবে, এখানে কোন ফাঁকা গাড়ি আসবে না।
তোমরা বিশ্রাম কর, সময় নাও, কোন তাড়াহুড়া নেই। রাতের মধ্যে মুযদালিফায় পৌঁছলেই হল। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেল রাগারাগি, গালি-গালাজ। কিন্তু আলহাজ্জ অটল। একটু যাই, একজন পারে না। সবাই মিলে একটু দাঁড়াই। সবাই মিলে চারিদিকে তাকাই, কোন ফাঁকা গাড়ি আসে কি-না। কিন্তু না, আলহাজ্জের কথাই সত্য, কোন ফাঁকা গাড়ি চোখে পড়ে না। বাধ্য হয়ে চলা শুরু, সাথে আলহাজ্জকে গালি-গালাজ। কেন তিনি আরাফা থেকে গাড়ি নিলেন না! কেউ বলেন, “তোমার সাথে আমাদের হজ্জ করার দরকার নেই। তুমি কেটে পড়। তোমার ইমামতি মানি না।” কেউ বলেন,
“তোমার সাথে এসে ভুল করেছি।” কেউ লাফ দিয়ে পিঠে উঠতে চায়। কেউ তাঁকে থাপ্পর দেখায়, কেউ বলেন “তুমি চলে যাও। না গেলে আমরা এখানে বসলাম, তোমার সাথে আর যাব না।”
আলহাজ্জ তার কালোমুখের সাদা দাঁতগুলো বের করে বলে, ড়শ নৎড়ঃযবৎ, বি ধৎব হড়ঃ ভধৎ ভৎড়স মুযদালিফা। আর একটু পরেই আমরা মুযদালিফা পৌঁছে যাব। এভাবে আমরা রাত প্রায় ৯ টায় মুযদালিফায় প্রবেশ করলাম। সবাই মাটিতে বসে পড়লেন, কেউ কেউ সেখানে শুয়ে পড়লেন। আলহাজ্জও বসে পড়লেন। আধা ঘণ্টা বিরতির পর আলহাজ্জ যখন আরও একটু ভিতরে মুযদালিফার মসজিদের আশ পাশে যাওয়ার কথা বলে দাঁড়ালেন, তখন আমাদের ছোট্ট কাফেলার ৬ জনই আলহাজ্জের দিকে তেড়ে আসলেন এবং অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করলেন। পাঁচজন সেখানে মাগরিব এশার নামায শুরু করলেন। আলহাজ্জ নির্বিকার। আমি দু’একবার তাঁকে বলার চেষ্টা করেছি। এরা যখন পারছেনা, তখন আপনি এদেরকে ছাড়ছেন না কেন? তখন তিনি কোন উত্তর দেননি। ৫ জনের নামায যখন শেষ হল, তাঁরা খাবার খাচ্ছেন, এ সুযোগে আলহাজ্জ বললেন, মসজিদের কাছে চল, পানিও আছে, খাবারও আছে। উপরন্তু মসজিদের জামাতে শরিক হয়ে ফজর পড়তে পারব। রাতে পাহাড় থেকে পাথর কুড়াতে পারব এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই মুযদালিফা পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়ে থাকব। এ পরিপ্রেক্ষিতে আবার সবাই রওয়ানা হলাম। প্রায় ৪৫ মিনিট পর মসজিদে খাওফ এর চত্বরে আমরা পৌঁছে গেলাম। সেখানে চারিদিকে দোকান, টিউবওয়েলের পানি এবং শোয়ার জন্য সমতল প্রান্তর দেখে সবাই মুগ্ধ হলাম। সবাই শুয়ে পড়লেন এবং নিমিষে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি আর আলহাজ্জ মসজিদে গিয়ে মগরিব-এশার নামায পড়লাম। দলে দলে হাজি মসজিদে আসছে নামায পড়ছে। রাত ১১টার দিকে আমি আলহাজ্জকে ডাকলাম। খাওয়ার কথা বললে তিনি অন্য সাথীদেরকে ডাকতে গেলেন, আমি বললাম, তাঁরা খেয়েছেন, ঘুম থেকে ডাকবেন না, বিরক্ত করবেন না। আমরা দু’জন খেয়ে মুযদালিফার পাহাড়ে পাথর কুড়াতে গেলাম। আমি আমার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাথর সংগ্রহ করলাম, মাঝে মাঝে তিনি বললেন এত বড় নয়, আরও ছোট পাথর কুড়াও ইত্যাদি। পাথর কুড়ানো শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফজরের আগে অন্য সাথীরা পাথর কুড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আলহাজ্জ বললেন, তোমাদের ৬ জনের পাথর আমি নিয়ে এসেছি। তবে সুন্নত আদায়ের জন্য পাহাড়টা ঘুরে আসতে পার। সঙ্গে পাথরও আনতে পার, কারণ অনেক লোকই রাতে পাথর সংগ্রহ করতে পারে না। তাদেরকে দেয়া যাবে। অবাক হওয়ার ব্যাপার, ফজরের নামাযের পর অনেক মানুষই রাতে পাথর কুড়ানো হয়নি, এ জন্য আফসোস করছে। আলহাজ্জ তার অতিরিক্ত পাথরগুলো বেশ কয়েকজনকে দিলেন। ফজরের নামায মসজিদে প্রধান জামাতের সঙ্গে আদায় করি। মসজিদ চত্বর
থেকে যারা বেশি দূরে অবস্থান করছিলেন, তাদের পক্ষে এশা ফজর কোনটাই মসজিদে জামাতের সাথে পড়া সম্ভব হয়নি। সূর্যোদয়ের আগেই আমরা মুযদালিফা ত্যাগ করি এবং আলহাজ্জ কারো সঙ্গে পরামর্শ না করেই একটি গাড়ি মিনা পর্যন্ত ভাড়া করেন।
মিনা মুযদালিফার রাস্তায় প্রচ- যানজটের কারণে আমাদেরকে অনেক দূর গাড়ি থেকে নামতে হয়। আলহাজ্জ আমাদেরকে সোজা বড় জামারায় পাথর মারার জন্য অগ্রসর হতে বলেন। জামারার কাছাকাছি পৌঁছে হালকা খাবার ব্যবস্থা করেন এবং সহজভাবে পাথর মারার নিয়মকানুন ও কলাকৌশল শিক্ষা দেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে জামারায় স্তম্ভের দিকে দৃষ্টি রেখে এদিক সেদিক ভ্রƒক্ষেপ না করে স্তম্ভের চারপাশে দেওয়ালের কাছে পৌঁছে পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। অনেকে অনেক দূর থেকে পাথর মারবে, আমাদের মাথায়ও দু’চারটা পড়তে পারে। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাবে না, রাগ করা যাবে না। কেউ ধাক্কা দিলে সেদিকও চোখ ফিরানো যাবে না। সবকিছুকেই উপেক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব স্তম্ভের দেওয়ালের কাছে পৌঁছতে হবে। তিনি নিজে আমাদের সামনে থেকে লক্ষ মানুষের প্রচ- ভিড়ের মধ্যে এপাশ ওপাশ ফাঁক-ফোঁকর দেখে অত্যন্ত দক্ষতা ও সচেতনতার সাথে অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেওয়ালের কাছে পৌঁছে গেলেন। আমরা দেখলাম, সেখানে তেমন ভিড় নেই। চাপাচাপি, ঠাসাঠাসি কিছুই নেই। আমাদের প্রত্যেককে দিব্য চোখে দেখে দু‘আ পড়ে এক একটি পাথর নিক্ষেপ করালেন। একটি পাথরও আমাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। চিৎকার হৈ চৈ রাগারাগি কিছুই স্পর্শ করল না। তবে দু’চার-দশটি পাথরের টুকরা ঘাড়ে পড়েছে বৈকি। সবার শেষে আলহাজ্জ নিজে তাঁর পাথর মারলেন এবং আমাদেরকে নিয়ে দেওয়ালের পাশ দিয়ে অতি আরামে ফিরে আসলেন। আমরা কুরবানির খোঁজ-খবর নিতে গেলাম। ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানির টাকা জমা দেওয়ায় কুরবানি নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি। পরে মাথা মু-ানোর জন্য পরামর্শ দেন। ইতিমধ্যে মসজিদে খাওফে নিয়ে গেলেন, সেখানে আমরা জামাতে যুহরের নামায আদায় করলাম এবং আসরের নামাযের আগেই তওয়াফে যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মক্কাতে পৌঁছলাম প্রথমে আমাদের নির্দিষ্ট বাসায় গেলাম। গোসল সেরে ইহরাম খুলে স্বাভাবিক কাপড়
চোপড় পরে তওয়াফের জন্য হারামে প্রবেশ করলাম।
তওয়াফ শেষে ভাড়া গাড়িতে মিনার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। উল্লেখ্য এখন আর আলহাজ্জ পায়ে হেঁটে নাকি গাড়িতে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন না। নিজে নিজে গাড়ি ভাড়া করে আমাদের নিয়ে রওয়ানা দেন। মিনার রাস্তায় তখন প্রচ- যানজট। আমাদের লক্ষ্য ছিল, মিনায় গিয়ে মাগরিবের নামায জামাতে পড়া, কিন্তু প্রচ- যানজটের কারণে রাস্তাতেই মাগরিবের সময় হল। তখন আমরা গাড়িতে। আমাদের সঙ্গীদের অনেকেই গাড়ি থামাও, নামায পড়ি, ওয়াক্ত চলে গেল ইত্যাদি মন্তব্য করতে থাকেন। আলহাজ্জ অধিকাংশ সময়ে না শুনার ভান করে দু’একবার অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠভাবে বললেন আমরা মসজিদে গিয়েই নামায পড়ব। গাড়ি যেখানে থামল, সেখান থেকে মসজিদে খওফ বেশ দূরে। আমাদেরকে হাঁটতে হবে। তাতে নামাযের ওয়াক্ত চলে যাবে। সঙ্গীদের প্রচ- চাপের মুখেও আলহাজ্জ মসজিদে খওফে গিয়েই নামায পড়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। যদিও হাজার হাজার মানুষ রাস্তাতে এবং তার আশে পাশের স্থানে নামায পড়ছে। এমনকি বিছানা ফেলে থাকারও ব্যবস্থা করেছে অনেকে। যা দেখে সঙ্গী-সাথীদের মনে হয়েছিল, মসজিদে খওফে কি আর জায়গা আছে? এবং এ প্রসঙ্গে আলহাজ্জকে কেউ কেউ পাগলও বলেছিল। কারণ মসজিদে জায়গা থাকলে কি আর এত লোক রাস্তায় থাকত? আলহাজ্জ যখন আমাদেরকে নিয়ে মসজিদে খওফে পৌঁছেন এবং আস্তে আস্তে সামনের দিকে অগ্রসর হন, আমরা দেখলাম মসজিদের ভিতর অনেক জায়গা ফাঁকা। মাঝ বরাবর একটি জায়গা নির্ধারণ করে আমাদেরকে নিয়ে জামাতে নামায পড়লেন। মিনাতে অবস্থানকালে এখানেই আমরা থাকব সে কথা জানিয়ে দিলেন। আমরা সবাই আশ্চর্য হলাম গাড়িতে থেকেই তিনি কীভাবে বুঝতে পারলেন যে মসজিদে খওফের ভিতরে জায়গা পাবে। আমরা দিব্যি আরামে মিনার তিনটি দিন সেখানে অবস্থান করলাম। মসজিদের ওযু খানায় ওযু করলাম। টয়লেট ব্যবহার করলাম, মসজিদের গোসল খানায় গোসল করলাম। মসজিদের ভিতরেই ঘুমালাম। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদের প্রধান জামাতে আদায় করলাম। নিরিবিলি নিভৃতে দু‘আ তসবীহ নফল নামায কুরআন তেলাওয়াত করলাম। আর নির্দিষ্ট সময়ে জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করলাম।
মিনাতে অবস্থানের সময়ে আমি আলহাজ্জকে খুবই একান্তে এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এত বাড়াবাড়ি এত দুর্ব্যবহার এবং বারবার আপনার সঙ্গে রাগারাগি করা সত্ত্বেও আপনি কেন আমাদেরকে ছেড়ে গেলেন না? আপনার নিজের হজ্জ করার জন্যতো আমাদের সঙ্গে থাকা আপনার জরুরী ছিল না, বরং আমাদেরকে বাদ দিয়ে আপনি অনেক আরামে আয়েশে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারতেন এবং গভীর মনোনিবেশ সহকারে আপনার প্রভুর সান্নিধ্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পারতেন। এত কিছুর পরেও আপনি কেন আমাদেরকে ধরে রাখলেন? মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে আলহাজ্জ বললেন, এ প্রশ্নটি আমি তোমার কাছে অনেক আগেই আশা করেছিলাম। রসূল স. এর একটি হাদিস আমার জানা আছে। তিনি বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি কোন হজ্জ পালনকারীকে যে কোন ব্যাপারে সহায়তা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে একটি কবুল হজ্জের ছওয়াব দান করেন। আমি জানি তোমাদের অবস্থা, তোমরা অনেক কিছুই জান না। এখানের কোন কিছুই তোমরা চিন না, তোমাদের ধৈর্য নেই, বুদ্ধি নেই। এ ধরনের গোবেচারাদেরকে নিজেদের উপর ছেড়ে দিলে হজ্জের যে কি অবস্থা হবে তা ভেবে আমি আতঙ্কিত ছিলাম। তোমাদের সঙ্গে থেকে এ ব্যাপারে আমার সাধ্যমত সাহায্য করে যদি তোমাদের হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করাতে পারি, তাহলে তো রসূলের স. হাদিস অনুযায়ী আমি সাতটি কবুল হজ্জের ছওয়াবের অধিকারী হব। তুমি কি আমাকে এতই বোকা পেয়েছ যে আমি এ সুযোগ হাতছাড়া করব? তোমাদের একটু রাগ একটু গালিগালাজ আমি সহ্য না করে এ লাভ থেকে মাহরুম থাকব কেন? তোমরা যাই কর, আমার নিজস্ব হজ্জের কার্যক্রমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করার মত সুযোগ বা ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই তোমাদের ছিল না। তাহলে আমি তোমাদেরকে ছাড়ব কেন?
মক্কা মদিনা মিনা আরাফা মুযদালিফা সবখানে আমাদের অন্যান্য সাথীরা নিজÑনিজ সুবিধা অনুযায়ী একাকী বা দু’চারজন মিলে খাওয়া দাওয়া করত। কিন্তু আলহাজ্জ খাওয়ার সময় অবশ্যই বলতেন, চল খেয়ে আসি। অন্যদিকে যখন বাইরে থেকে খাবার নিয়ে রুমে আসতেন, তখন শুধু তাঁর একার জন্য নয় বরং সবার জন্য খাবার আনতেন। রুমে ঢুকে খাবার সাজিয়ে সবাইকে একে একে ডাকতেন। যাঁরা বলতেন আমরা খেয়েছি, অনেক সময় তাঁদের মুখের কাছে খাবার নিয়ে যেতেন। বলতেন চষবধংব একটু শরিক হও, তুমি আল্লাহর মেহমান, তুমি না খেলে আমি কীভাবে খাই? তাঁর কথার মধ্যে এত আন্তরিকতা, এত দরদ, যা অতি আপনজনদের কাছ থেকেও আশা করা যায় না। আমরা যখন গোসল করতাম, টয়লেট ব্যবহার করতাম, তখন কাউকে কিছু না বলে টয়লেটে চলে যেতাম। কিন্তু তিনি যখন যেতেন, তখন বলতেন, বাথরুম বা টয়লেটে কেউ যাবে নাকি? আমরা গোসলের সময় স্যুটকেস থেকে সাবান বের করে নিতাম, আবার গোসল শেষ হলে এনে স্যুটকেসে রেখে দিতাম। আলহাজ্জ সাবান বের করে বাথরুমেই রাখতেন, আর বলতেন এখানে সবার জন্যে সাবান রাখলাম, ব্যবহার করিও কিন্তু। তাঁর সাবান বাথরুমে থাকা অবস্থায় অন্য কেউ সাবান নিয়ে বাথরুমে ঢুকলে হাত থেকে সাবান কেড়ে রেখে দিতেন।
মক্কা-মদিনা উভয় স্থানে অন্যেরা স্যুটকেস ব্রিফকেস কাপড়-চোপড় খেজুর খুরমা, আতর তসবীহ টুপি, জায়নামায কেনার জন্য মাঝে মধ্যে দোকানপাটে যাতায়াত করতেন।
সেখানে আলহাজের প্রধান টার্গেট থাকত, ধর্মীয় বইপত্র ও ইসলামি শিক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের দিকে। হজ্জ সমাপন শেষে ফেরার পথে জেদ্দা বিমান বন্দর এসে আমাকে বললেন দশটি খুবই দু®প্রাপ্য মূল্যবান গ্রন্থ কিনেছি, প্রায় হাজার দেড়েক পাউন্ড দিয়ে। আমি তাঁকে একটি জুব্বা দেওয়ার নিয়ত করেছিলাম। সাধারণত কেনাকাটার সময় তাঁকে আমি সাথে নিতাম। তাঁকে বুঝতে না দিয়ে আমি তাঁর জন্য একটা জুব্বা পছন্দ করলাম। যেহেতু তিনি খুব লম্বা ছিলেন, আমি সাইজটা আরও একটু লম্বা দিতে বললে তিনি বুঝে ফেলেন। বললেন যে, নিউক্যাসলে আমার মত লম্বা কেউ নেই। আর তোমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও এত লম্বা কেউ হবেনা, অতএব তুমি এটা কিন না। তিনি বললেন, আমি বই কিনতে গেলে যদি টাকা কম পড়ে তখন তোমার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিব। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর টাকা কম পড়েনি।
আমার বড় মেয়ের জন্য একটি সোনার চেইন কেনার ইচ্ছা হল। কিন্তু আইন-কানুনের বাধা আছে কিনা তা আমার জানা ছিলনা। দোকানে গিয়ে আলহাজ্জ দোকানিকে জিজ্ঞেস করেন, এখান থেকে কি ইংল্যান্ডে সোনা কিনে নেওয়া যায়? দোকানদার বলে প্রতিদিন হাজার হাজার কেজি সোনা বিক্রি করি, কেউ একথা জিজ্ঞেস করে না। বেআইনি হলে আমরা এত সোনা বিক্রি করতে পারতাম না। একদিন তিনি আমাকে ট্রাভেল অফিসে নিয়ে গেলেন। সেখানে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কতটুকু সোনা নিতে চাও? মেয়ের জন্য একটা চেইন মাত্র। ব্যবহার করা অবস্থায় গহনা হিসেবে তোমার সঙ্গে যতটুকু সম্ভব তা তুমি নিতে পার। গহনা নয়, এমন কোন সোনা নেওয়া নিষেধ। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিমাণগত কিছু বিধি-নিষেধ আছে। যেদিন আমার মেয়ের জন্য চেইন কেনা হলো সেদিন আমাকে বলে রাখলেন, এয়ারপোর্টে রিপোর্টিং এর সময় এ কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিও। ফিরতি ফ্লাইটের জন্য জেদ্দা বিমান বন্দরে রিপোর্টিং চলছে। আমাদের ব্যাগেজ, আসার সময়ের তুলনায় সংখ্যা এবং ওজনে বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্থক্য হল, আলহাজ্জের লাগেজ বলতে শুধু বইপত্র, আর আমাদের লাগেজ বলতে নতুন স্যুটকেস। আমি একটি স্যুটকেস কিনেছিলাম। ট্রাভেল রুলসে আটকে যাওয়ার ভয়ে আমি চেইনটি আগেই বড় স্যুটকেসে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। যখন আমাদের রিপোর্টিং শেষ হল, শুধু হাতব্যাগ আমাদের কাছে থাকল। “মহসিনার চেইনটা দাও। আমি অফিসারকে দেখাই। এটা নেওয়া আইনগত বাধা আছে কিনা জেনে নিই, বললেন আলহাজ্জ।” আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, বড় স্যুটকেসের ভিতরে এটা লাগেজে দিয়ে দিয়েছি। অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, অফিসারকে গিয়ে বললেন, মেয়ের জন্য একটা চেইন কিনেছি, লাগেজে দিয়েছি, কোন অসুবিধা নাইতো? অফিসার বললেন না, কোন অসুবিধা নেই। অফিসারের মুখে চোখে বিস্ময়ের ছাপ লক্ষ্য করলাম। আমি কিন্তুু অস্থির, বলাতে না জানি কোন বিপদ ঘটে। আলহাজ্জ ফিরে এসে বললেন, কোন অসুবিধা নেই। তবে ওটা তোমার কাছে রাখাই উচিত ছিল। তাঁকে বললাম, যদি অফিসার এটা বেআইনি বলত তা হলে কি করতেন? বললেন, রেখে যেতাম। তাঁর এ স্বচ্ছতা ও সরলতা আমাকে আরও মুগ্ধ করে।
হিথরো বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে রেন্ট-এ-কারের দোকানে অপেক্ষা করছি। গাড়ী নেওয়া সম্বন্ধে আলহাজ্জ কথাবার্তা বলছেন। ঘণ্টা খানেক পরে আলহাজ্জ বলেন বিরাট সমস্যা। নিউক্যাসলে স্থায়ী কোন বাসিন্দার টেলিফোন নম্বর দিতে হবে। গ্যারান্টার হিসেবে তিনি রাজী কিনা তা সরাসরি এঁরা ফোন করে শুনবে। স্থায়ী বাসিন্দাদের অনেকেই আমাদের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তাদের টেলিফোন নম্বর মুখস্ত নেই। আমি আলহাজ্জকে বললাম, যারা স্থায়ী নয় কিন্তু স্থায়ীদের টেলিফোন নম্বর জানে এমন কাউকে ফোন করে স্থায়ী কারোও ফোন নম্বরটা নিয়ে নিলেইতো হয়। আলহাজ্জ বলেন, এটা এদের নিয়মের পরিপন্থী। ঘণ্টা দুয়েকের চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন স্থায়ী বাসিন্দার টেলিফোন একজনের মনে আসল। দশ মিনিটেই গাড়ী নিয়ে আলহাজ্জ নিউক্যাসলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ড্রাইভিংটা আলহাজ্জই করলেন।