নফল নামাজের পরিচয় ও প্রকারভেদ
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে সতেরো রাকাত ফরজ নামাজ, তিন রাকাত ওয়াজিব বিতির নামাজ, চার ওয়াক্তে বারো রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদা নামাজ, দুই ওয়াক্তে আট রাকাত সুন্নতে জায়েদা নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাজ হলো নফল নামাজ।
নফল নামাজের নিষিদ্ধ সময়
সূর্যোদয়ের সময় সব নামাজ নিষিদ্ধ, সূর্য মাথার ওপর স্থির থাকা অবস্থায় নামাজ পড়া মাকরুহে তাহরিমি, সূর্যাস্তের সময় চলমান আসর ব্যতীত অন্য কোনো নামাজ বৈধ নয়। এ ছাড়া ফজর নামাজের ওয়াক্ত হলে তখন থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসর ওয়াক্তে ফরজ নামাজ পড়া হলে তখন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো ধরনের নফল নামাজ পড়া নিষেধ। এই পাঁচটি সময় বাদে অন্য যেকোনো সময় নফল নামাজ পড়া যায়। (আওকাতুস সালাত)।
নফল নামাজের নিয়ত
নফল নামাজগুলো অধিকাংশই সুন্নত। তাই নিয়তে সুন্নত বলা যাবে, নফল বললেও হবে; সুন্নত–নফল কোনো কিছু না বলে শুধু তাকবিরে তাহরিমা দিয়ে আরম্ভ করলেও হয়ে যাবে। দুই রাকাতের বেশি নফল নামাজের নিয়ত করে তা ছেড়ে দিলে বা যেকোনো জোড় সংখ্যা পূর্ণ হওয়ার পর বিজোড় সংখ্যায় নফল নামাজ ভেঙে গেলে; পরে এ জন্য শুধু দুই রাকাত আদায় করা ওয়াজিব হবে। (হিদায়া)
নফল নামাজের সূরা কিরাআত
নফল নামাজ যেকোনো সূরা বা আয়াত দিয়ে পড়া যায়। নফল নামাজে সূরার তারতিব বা ধারাক্রম জরুরি নয়। নফল নামাজের সূরা কিরাআত নীরবে পড়তে হয়; তবে রাতের নফল নামাজ ইচ্ছা করলে সরবেও পড়া যায়। বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন নফল নামাজের বিভিন্ন সূরা কিরাআত ও বিশেষ বিশেষ নিয়ম বর্ণিত আছে। সম্ভব হলে তা অনুসরণ করা উত্তম; তবে জরুরি নয়। নফল নামাজে যত ইচ্ছা তত দীর্ঘ কিরাআত পাঠ করা যায়। এতে রাকাত দীর্ঘ করার জন্য এবং তিলাওয়াতের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য একই রাকাতে বিভিন্ন সূরা ও বিভিন্ন আয়াত পড়া যায় এবং একই রাকাতে একই সূরা বারবার পড়া যায়। নফল নামাজে কিরাআতে তিলাওয়াতের তারতিব বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি নয়। নফল নামাজে রুকু, সিজদাসহ প্রতিটি রুকন বা পর্ব দীর্ঘায়িত করা সুন্নত ও মোস্তাহাব। এ জন্য রুকু ও সিজদায় তাসবিহ অনেকবার পড়া যায় এবং অন্যান্য পর্বে বেশি পরিমাণে বিভিন্ন দোয়া (যা কোরআন-হাদিসে আছে) পাঠ করা যায়। (কানজ)
তাহিয়্যাতুল অজুর নামাজ
অজু করার পরপরই এই নামাজ দুই রাকাত পড়তে হয়। ওয়াক্ত মাকরুহ হলে, মাকরুহ ওয়াক্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অজু করে দুই রাকাত নামাজ ইখলাসের সঙ্গে পড়বে, তার বেহেশত লাভ হওয়া অবধারিত।’ (মুসলিম ও আবু দাউদ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি অজু ভাঙার পর অজু করল না, সে আমাকে অবজ্ঞা করল; আর যে ব্যক্তি অজু করার পর দুই রাকাত (নফল) নামাজ পড়ল না, সেও আমাকে অবহেলা করল। (হাদিসে কুদসি)।
দুখুলিল মাসজিদের নামাজ
মসজিদে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, বসার আগেই দুই রাকাত দুখুলিল মাসজিদ নামাজ পড়তে হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন বসার আগেই তার দুই রাকাত নামাজ পড়া উচিত।’ (হাদিস)। তবে যদি মাকরুহ ওয়াক্ত হয়, তাহলে মাকরুহ ওয়াক্ত শেষ হলে পড়বে। এ জন্য বসে অপেক্ষা করতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগিরি)।
সালাতুস সফর এবং দুখুলিল মানজিল ও
খুরুজুল মানজিলের নামাজ
বাড়ি থেকে সফরে বের হওয়ার আগে চার রাকাত নফল নামাজ পড়া অতীব বরকতময়। এই নামাজকে সালাতুস সফর বা সফরের নামাজ বলা হয়। সফর থেকে বাড়ি ফিরলে বা সফরে গন্তব্যে পৌঁছালে অথবা সফরে কোথাও অবস্থান করলে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে। এই নামাজকে সালাতু দুখুলিল মানজিল বা মঞ্জিলে প্রবেশের নামাজ বলে। একইভাবে বাড়ি থেকে সফরে বের হওয়ার সময় কিংবা সফর থেকে বাড়িতে যাওয়ার সময় বা সফরের মাঝে অবস্থান থেকে রওনা দেওয়ার সময় দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে হয়। এই নামাজকে সালাতুল খুরুজিল মানজিল বা মঞ্জিল থেকে প্রত্যাবর্তনের নামাজ বলে। (তান্বিহুল গাফিলিন)।
সালাতুল হাজাত
সালাতুল হাজাত প্রসঙ্গটি বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মিশকাতসহ বহু হাদিস গ্রন্থে রয়েছে। পাক-পবিত্র হয়ে দোয়া, ইস্তিগফার ও কয়েকবার দরুদ শরিফ পড়ে একাগ্রতার সঙ্গে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে। নামাজ শেষে ১১ বার ‘ইয়া কাজিয়াল হাজাত’ (হে প্রয়োজন পূর্ণকারী) পড়বে এবং আরও কয়েকবার দরুদ শরিফ পড়ে ভক্তি ও মহব্বতের সঙ্গে উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ার জন্য দোয়া ও মোনাজাত করতে হবে। ইনশা আল্লাহ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।
সালাতু কাজায়িদ দাঈন বা ঋণ পরিশোধের নামাজ
হজরত আবু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ঋণ আছে; কিন্তু তা পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি দুই রাকাত করে চার রাকাত নামাজ আদায় করো; ইনশা আল্লাহ তোমার ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে।
সালাতুল ফাকা
হজরত হুসাঈন (রা.) পুত্র আলী (রা.) কে বলেন, বত্স! শোনো, যখন তোমার ওপর কোনো বালা-মুসিবত আপতিত হয় অথবা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তুমি চার রাকাত নফল নামাজ পড়বে। আলী ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি এই নামাজ পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার বিপদ ও অভাব দূর করবেন।
সালাতুস শোকর
মনের কোনো আশা বা ইচ্ছা পূর্ণ হলে অথবা কোনো বিপদাপদ বা বালা-মুসিবত দূর হলে এবং আল্লাহর তরফ থেকে কোনো নিয়ামতপ্রাপ্ত হলে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করতে হয়। একে সালাতুস শোকর বা কৃতজ্ঞতার নামাজ বলে।
সালাতুত তাওবা
সালাতুত তাওবা বিষয়টি আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদসহ অনেক গ্রন্থেই রয়েছে। কোনো গোনাহ হয়ে গেলে; দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে, তাওবা ইস্তিগফার করে, দরুদ শরিফ পড়ে কান্নাকাটিসহ আল্লাহর কাছে দোয়া ও মোনাজাত করলে আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করবেন। এই নামাজকে সালাতুত তাওবা বা তাওবার নামাজ বলা হয়।
সালাতুল মাতার
হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আকাশে মেঘ দেখে যদি কোনো ব্যক্তি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে; আল্লাহ তাকে বৃষ্টির প্রতি ফোঁটায় ১০টি করে নেকি দান করবেন। বৃষ্টির পানিতে গাছপালায় ও তৃণলতায় যত পাতা গজাবে প্রতি পাতার বিনিময়ে তাকে আরও ১০টি করে নেকি দেওয়া হবে।
সালাতুল নাউম
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শোয়ার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ে, তা তার জন্য এক হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও এক হাজার জামাকাপড় (পোশাক) দান করার চেয়ে উত্তম।
সালাতুল সাকরাতুল মউত
হাদিস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার মাঝখানে দুই রাকাত নামাজ পড়বে; তার মৃত্যুযন্ত্রণা কম হবে। (সূত্র: ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, খাজিনাতুল আসরার, নফল সালাতের ফজিলত)।